ইট পাটকেল পর্ব ৭ - ইট পাটকেল সকল পর্বের লিংক
ক্লান্ত পায়ে বাড়িতে ঢুকলো আশমিন। ড্রয়িং রুমে কামিনী চৌধুরী আর আমজাদ চৌধুরী বসে আছে। নিজেদের মধ্যে হয়তো কিছু আলোচনা করছে।আশমিন কে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে চিন্তিত চোখে তাকালো আমজাদ চৌধুরী।কামিনী চৌধুরীর কপালে ও ভাজ পরেছে।আশমিন কারোর দিকে না তাকিয়ে সোজা নূরের রুমে চলে গেলো।
আরো পড়ুন : ইট পাটকেল পর্ব ১
— আমাকে একটু জরিয়ে ধরবে নূর?
আশমিনের এমন গলা শুনে হালকা কেপে উঠলো নূর। জহুরি চোখে পর্যবেক্ষণ করল আশমিন কে।রাগী গম্ভীর লোকটা কে আজ ভঙ্গুর লাগছে।নূর এগিয়ে গিয়ে আশমিন কে হালকা হাতে জরিয়ে ধরলো। আশমিন তাদের মধ্যকার ফাকা টুকু ঘুচিয়ে নূর কে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। নূরের দম বন্ধ হয়ে আসছে। তবুও কিছু না বলে আশমিন কে শান্ত হতে সময় দিলো।আশমিনের বুকের কাপনি স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে।কপালে কয়েকটা ভাজ পরলেও খুব একটা পাত্তা দিল না।কয়েক মিনিট এভাবে কাটার পর নূর নিজের মুখ খুললো।
— খারাপ সময়ে এভাবে জরিয়ে ধরার জন্য একজন মানুষ দরকার।যে হবে একান্ত ব্যক্তিগত। সে দিক থেকে আপনি আমার চেয়ে লাকি মন্ত্রী সাহেব। আমি আবার খারাপ সময়ে মানুষ কে দুরছাই করতে পারি না।
নূর কে ছেড়ে দূরত্ব বজায় রেখে দাড়ালো আশমিন।নূরের সুক্ষ্ম খোচা সে বুঝতে পেরেছে। নির্লিপ্ত চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো। নূর গভীর মনযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো পুরোটা। আশমিন বরাবরের মতো শান্ত গলায় বললো,
— তুমি আমার থেকেও ভাগ্যবান নূর। আমি আগেও বলেছি এখন ও বলছি,কখনো এমন কোন কাজ করবে না যার জন্য পরে অপরাধবোধে ভোগো।ধনুক থেকে বেরিয়ে যাওয়া তীর আর মানুষের মুখের কথা কখনো ফেরত আসে না। তোমাকে বলা আমার কথাগুলো ও কিন্তু আমি ফিরিয়ে নিতে পারিনি। আমার তখনকার অপারগতা ও ওই কথাগুলো কে মলিন করতে পারে নি। একই ভুল তুমি করলে আমার খারাপ লাগবে।
কথা গুলো বলে যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই চলে গেলো আশমিন। নূর শান্ত চোখে তাকিয়ে দেখলো আশমিনের চলে যাওয়া।কিছুতো একটা হয়েছে। কিন্তু কি হয়েছে তা বুঝতে পারছে না নূর।
সেদিন রাতে এভাবে নূরের লাগানো আ*গুন নিভিয়ে দিয়ে নূরকে অনেকটা কাছে টেনে নিয়েছিল আশমিন।দীর্ঘ ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে এত কাছাকাছি আসা হয়নি তাদের।আশমিন অনেকটা ডুবে গিয়েছিল নূরের মাঝে ভেজা দুটো শরীর একসাথে লেপ্টে ছিল অনেকটা সময়। আশমিন অবাধ বিচরণ করেছে নূরের উপর। দুজনের নিশ্বাস পাল্লা দিয়ে ভারী হচ্ছিল। আশমিন নূরের বুক থেকে মুখ তুলে আশমিনের ওষ্ঠদ্বয় দখল করে নিতেই নূর আশমিন কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। হুট করেই আশমিন কে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। নূর চোখ বন্ধ করে হাপাচ্ছে।উপর থেকে পানি পরা বন্ধ হয়নি এখনো। নূরের শরীরে পরা পানির বিন্দু গুলো এক একটা মুক্তোর দানা মনে হচ্ছে আশমিনের কাছে।গায়ে লেপ্টে থাকা সাদা শার্ট টা খুলে ফ্লোরে ছুড়ে দিয়ে নূর কে কোলে তুলে নিলো আশমিন। ততক্ষনে ঘোর থেকে বেরিয়ে এসেছে নূর।আশমিনের কোল থেকে নামার জন্য মোচড়া মুচড়ি করতেই আশমিন বাকা হাসলো। নূরের রক্তিম নাকে হালকা কামড় দিয়ে ভরাট গলায় বলল,
— মোচড়া মুচড়ি করে লাভ নেই। বাসর করতেই তো এসেছো।এখন তোমাকে কিছু না করেই ছেড়ে দিলে তুমি আমার সম্পর্কে ভুলভাল ভাবতে পারো।তবে আমি এভাবে বাসার করতে চাই না বুঝলে।তাই আজ শুধু হতে হতে ও হইলো না টাইপ বাসর হবে। আগুনের ভেজা বাসর।
নূর হতভম্ব হয়ে কথা বলতেই ভুলে গেলো। হাজার কিল ঘুসি দিয়েও আশমিনের হাত থেকে মুক্তি পেলো না। নিজের নখ রাক্ষুসিদের মতো না রাখার জন্য নিজেকেই ভৎসনা করতে লাগলো। তাহলে অন্তত খামচে খামচে এই অসভ্য লোকের চেহারার নকশা বদলে ফেলা যেতো। সেদিন এক অন্য আশমিন কে আবিষ্কার করেছিল নূর।যাকে ভাবলে মনের মধ্যে শুধু একটা কথাই আসে।আর তা হলো, অসভ্য অসভ্য অসভ্য।
পরের দিন থেকেই দুজন ঠান্ডা জ্বর লাগিয়ে কেলেঙ্কারির বাধিয়ে ফেললো। আশমিন কে দেখে সানভির মনে হলো তার সামনে একটা পাকা টমেটো ঝুলে আছে।বাসর করতে গিয়ে এভাবে জ্বর বাধানোর কি হলো আজব!এমন হলে তো সে মোটেও বাসর টাসর করবে না। আশমিন জ্বর নিয়ে পরপর কয়েক টা মিটিং করে ফেললো। এদিকে নূর শুধু বিছানায় শুয়ে শুয়ে আশমিন কে বকে গেলো। কয়েক হাজার অভিশাপ দিয়ে ও খান্ত হলো না। আশমিনের কাবার্ডের সমস্ত সাদা শার্ট গুলো জ্বালিয়ে দিলো।এই সাদা শার্ট পরা দেখেই সে পিছলে গিয়েছিল। দুই দিন রুমের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে রইলো। এই অবস্থায় বাইরে গিয়ে লোক হাসানোর মানেই হয় না। অথচ আশমিন নির্দিধায় নিজের কাজ করে গেলো।একবেলায় জ্বর ছেড়ে গেলেও ঠান্ডা তাকে কুপকাত করে ফেললো। আশমিন কয়েক বার বিরবির করে বলে ও ফেললো, বউয়ের অভিশাপ বউয়ের অভিশাপ।
তার পর থেকে টানা সতের দিন দুজনের দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ। নূর আশমিন কে এড়িয়ে চলেছে এ কয়দিন।আশমিন ও সেদিকে পাত্তা দেয় নি। আজ হুট করেই আশমিন এভাবে সামনে চলে এসে বিভ্রান্ত করে দিয়ে গেলো নূর কে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো নূর। আকাশের মস্তো বড় চাদের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো নিজের অগোছালো জীবন নিয়ে।সব কিছু স্বাভাবিক থাকতে পারতো।অন্য সব মেয়েদের মতো সে ও একটা সাজানো গোছানো সংসার করতে পারতো।কয়েকজন মানুষের লোভ তাদের জীবন টা এলো মেলো করে দিয়েছে।ফোনের শব্দে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো নূর।
— বলো অমি।
— ম্যাম, মতি মিয়ার খোজ পাওয়া গেছে।আজ সকালে আশমিন স্যারের লোকেরা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।কিছুক্ষণ আগে থেকেই তার আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার পরিবার ও কয়েক ঘন্টার মধ্যে উধাও।
— তাদের খোজা বন্ধ করো অমি।আপাতত তোমার স্যারের উপর নজর রাখো।সে যেন বুঝতে না পারে কিছু।
— ওকে ম্যাম।
অমি ফোন রাখতেই নূর চাঁদ দেখায় মনোযোগ দিল।
— এই খেলার শেষ ধাপে আপনি ই আমাকে নিয়ে যাবেন মন্ত্রী সাহেব। আজ থেকে আমার কাজ গুলো আপনার। (বাকা হেসে)
সকালের নাস্তার টেবিলে আশমিন কে সবার আগে উপস্থিত হতে দেখা গেলো। নিজের মতো করে গুন গুন করছে সে।নূর রেডি হয়ে এসে বসলো তার চেয়ারে।আশমিনের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। আমজাদ চৌধুরীর ছেলের মতিগতি ভালো ঠেকছে না। কামিনী চৌধুরীর সেদিকে ধ্যান নেই। সে নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছে। একজন গার্ড এসে একটা খাম কামিনী চৌধুরীর দিকে এগিয়ে দিলো। রেজিস্ট্রার করা এনভেলাপ। কামিনী চৌধুরী ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকালো।
— এখানে আপনার সাইন লাগবে ম্যাম।
গার্ডের কথায় রেজিস্ট্রার খাতায় সাইন করে খামটি হাতে নিল সে।ভিতর থেকে বের হওয়া ডকুমেন্ট পড়তেই মাথা ঘুরে গেল তার।হাত পা কাপতে লাগলো। নূর বাকা হেসে নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছে। আমজাদ চৌধুরী সন্দিহান গলায় বলল,
— এটা কিসের কাগজ কামিনী?
কামিনী চৌধুরী কিছু বলতে পারলো না। অতিরিক্ত শকে কথা বের হচ্ছে না মুখ থেকে। নূর সেদিকে তাকিয়ে বাকা হেসে বললো,
— কোর্ট থেকে নোটিশ এসেছে।কোম্পানি থেকে সারে তিন শ কোটি টাকা হেরফের করার জন্য তাকে কোম্পানি কে চার শ কোটি টাকা ফেরত দিতে হবে। তা ও আগামি দুই মাসের মধ্যে।
আমজাদ চৌধুরী হতভম্ব হয়ে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালো। আশমিন একটা পেপার আমজাদ চৌধুরীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
— এসব বাদ দাও আব্বু।এখানে একটা সাইন লাগবে। তারাতাড়ি করে দাও তো।
আমজাদ চৌধুরী হতভম্ব চোখে পেপারের দিকে এক পলক তাকালো। কয়েক পলক সেদিকে তাকিয়ে থেকে নির্লিপ্ত ভাবে সাইন করে দিলো পেপারে।
ছাদের রেলিংয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে আশমিন।সব সময় গোছানো ছেলেটা আজ প্রচন্ড অগোছালো হয়ে নিজের জীবনের হিসেব মিলাতে ব্যস্ত। অনুভূতিহীন চোখ গুলো আজ পরাজিত সৈনিকের মতো নত হয়ে আছে।আমজাদ চৌধুরী এসে সন্তপর্ণে ছেলের পাসে বসলো।আশমিন বাবার দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমজাদ চৌধুরী তপ্ত শ্বাস ছেড়ে আশমিনের কাধে হাত রাখলো।দুজনের সম্পর্ক সাপে নেউলে হলেও এক জন আরেকজনের জন্য জান দিতেও প্রস্তুত। দুজনের সম্পর্ক অনেকটা বাচ্চা কালের বন্ধুদের মতো। সারাক্ষণ একজন আআরেকজনের পিছনে লেগে থাকতে মজা পায় তারা।কিন্তু একজনের মনের আকাশে মেঘ জমলে আরেক জন অস্থির হয়ে উঠে।
— কিছু বলবে আব্বু?
— কি হয়েছে বাবা।সকাল থেকেই লক্ষ্য করছি।এমন উদ্ভট বিহেইভ করছো কেন?
আশমিন শান্ত চোখে তাকালো তার বাবার দিকে।বাবার সহজ সরল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বুক টা হু হু করে উঠল।এমন একজন মানুষ কে কেউ কিভাবে ঠকাতে পারে! সেই মানুষ টা যদি হয় নিজের গর্ভধারিণী মা এটা জানার পর এই মানুষ টা পারবে তো নিজেকে সামলাতে?
— আমাকে খুলে বলো বাবা।
আমজাদ চৌধুরীর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো আশমিন। বাবার চোখের দিকে তাকালে কষ্ট হয় খুব।বাবা কে ভালোবাসে।প্রচন্ড ভালোবাসে। সেই বাবা কে এভাবে কেন ঠকাল কামিনী চৌধুরী! চোখ বন্ধ করে ফেললো আশমিন। রাগ হচ্ছে তার। সব কিছু ধ্বংস করে দেয়ার মতো রাগ।
— ছবি গুলো দেখেছো আব্বু?
আমজাদ চৌধুরী হতাশ হলেন।ছেলের মুখ দেখে কখনোই তার মনের খবর বোঝা যায় না।তাই সে সরাসরি জানতে চেয়েছিল।কিন্তু ছেলে তার মুখ খুলছে না।
— এসব কি ধরনের কথা আশমিন? আমি কেন আবার বিয়ে করতে যাবো? তুমি জানো তোমার এই আচরণের জন্য তোমার আম্মু কতটা কষ্ট পেয়েছে? তোমার কাছে এমন কথা আশা করি নি।
আমজাদ চৌধুরীর গলায় তীব্র হতাশা আর ক্ষোভ। আশমিন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আমজাদ চৌধুরীর দিকে। ছেলের দৃষ্টি দেখে থমকে গেলো আমজাদ চৌধুরী।দুই হাতে ঝাপটে ধরে কেদে উঠলেন।
— কি হয়েছে বাবা? আমাকে বলো?তুমি এখনো আমার কাছে সেই ছোট্ট আশু।যাকে আমি কাধে নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছি। দুই হাতে যাকে আমি প্রথম কোলে তুলে নিয়েছি।হাটা শিখিয়েছি, কথা বলা শিখিয়েছি।তুমি আমার কাছে এখনো সেই আধো আধো বুলিতে আব্বু ডাকা আশমিন ই আছো।আগে যেভাবে আব্বুর কাছে নিজের সমস্ত অভিযোগ অভিমান খুলে বলতে তেমন এখনো বলো বাবা।
আশমিন তার বাবাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো। ছেলের চোখের পানি দেখে দিশেহারা হয়ে গেলো আমজাদ চৌধুরী।আজ পর্যন্ত ছেলে কে সে কাদতে দেখে নি। এমন কি নূর চলে যাওয়ার পরে যখন মাইনর এট্যাকের জন্য হসপিটালাইজ হলো তখন ও আশমিন কাদে নি।রক্তিম চোখে শুধু তাকিয়ে থাকতো।
আজ কি এমন হয়েছে যার জন্য তার ছেলের চোখের পানি কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে?
কয়েক মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিলো আশমিন। চোখের পানি মুছে আমজাদ চৌধুরীর ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকালো।তার কান্না ভেজা চোখ দেখে সেও কেদে দিয়েছে। ভিতর থেকে কান্না গুলো আবার দলা পাকিয়ে এলো। আশমিন আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,
— আমার কথা মেনে নাও বাবা।
— পাগল হয়ে গেছো?নিজের মায়ের সংসার ভাঙ্গতে চাইছো!আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি তোমার কথা শুনে। (হতভম্ব গলায়)
— আমি চাই সে কষ্ট পাক আব্বু।আপনজন হারালে কেমন লাগে তার বোঝা উচিত। কাছের মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা করলে কতটা কষ্ট হয় তা হাড়ে হাড়ে বুঝবে এবার।তার লোভ তাকে কোথায় নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে আমি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাই আব্বু। আর তাকে তার সম্রাজ্য থেকে টেনে নামাবো আমি।
আমজাদ চৌধুরী এবার ঘামতে লাগলো। কি করেছে কামিনী? এই প্রশ্ন টা করতে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সে এমন কিছু শুনতে চায় না যা শুনলে সে ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবে।
— তুমি সহ্য করতে পারবে না আব্বু।তার মৃ*ত্যু অবধারিত। তার লোভ তাকে খু*ন করবে। আগামী সপ্তাহে তোমার বিয়ে। এখন গিয়ে ঘুমাও।মেয়ে আমি নিজেই পছন্দ করে নিবো।
— আমি ওকে ভালোবাসি আশমিন।
আমজাদ চৌধুরীর গলা টা হালকা কেপে উঠলো।
— সে তোমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়।
আশমিনের গলা নির্লিপ্ত। আমজাদ চৌধুরী টলমল পায়ে চলে গেলেন ছাদ থেকে।
নূর তীক্ষ্ণ চোখে সবকিছু দেখলো।এতক্ষণ সে ছাদের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল।পরিস্কার ভাবে কিছু না বুঝলে ও এটা ঠিক বুঝলো যে আশমিনের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।সকালে সব কিছু মজা ভেবে উড়িয়ে দিলেও এখন বিষয় টা খুব ভাবাচ্ছে তাকে।হঠাৎ হেচকা টানে তাল সামলাতে না পেরে কারোর শক্ত বুকের সাথে তার মাথার সংঘর্ষ হয়ে গেলো। ব্যথা পেলেও কিছু বললো না সে। এটা আশমিন ছাড়া কেউ না সে জানে।
— প্রেম পাচ্ছে?
বিরক্ত চোখে তাকালো নূর।প্রেম কেন পাবে আজব? এখানে প্রেম পাওয়ার মতো কি হয়েছে এখানে?একদিন নিজের মন মীরজাফরি করেছে বলে কি প্রতিদিন ই সে পিছলে যাবে নাকি।
— ছারুন।সব সময় এভাবে গা ঘেষাঘেসি করেন কেন?
আশমিন অবাক হওয়ার ভান করে আর্তনাদ করে বললো,
— মিথ্যা কথা! আমি সারাক্ষণ তোমার গা ঘেসাঘেসি করি না নূর। আমার কতো কাজ জানো তুমি? আমি শুধু মাঝে মধ্যে হালকা ঘেষাঘেসি করি।তাতেই তুমি দু দিন রুম থেকে বের হতে পারো না(শয়তানি হেসে)।
নূর হা করে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে চিৎকার করে বললো, চুপ করুন। আপনি একটা অশ্লিল গিরগিটি।
আশমিন নূরের মুখভঙ্গি কে পাত্তা না দিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
— আমার কি মনে হয় জানো?আমরা যখন জেনারেশন বাড়ানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করতে ট্রায় করবো তখন আর তোমাকে খুজেই পাওয়া যাবে না। দেখা গেলো তুমি কোন সাইন্স ল্যাবে অসহায় হয়ে ঝুলছো।তাই তোমার এতো বড় একটা টাস্কে ইনভলভ হওয়ার আগে উচিত নিয়মিত একটু একটু করে প্র্যাকটিস করা। আসো আমরা বরং সময় টাকে কাজে লাগাই।আমি থাকতে তোমার কোন চিন্তা নেই।মিনিষ্টার আশমিন জায়িনের বউ হয়ে তুমি কোন ল্যাবে কংকাল হয়ে ঝুলবে এটা মেনে নেয়া যায় না। ব্যপার টা লজ্জাজনক।
নূর হতভম্ব হতেও ভুলে গেলো। আশমিনের কথা গুলো মাথায় তাল গোল পাকিয়ে খিচুড়ি হয়ে গেলো। সে শুধু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। এদিকে আশমিনের কয়েকদফা চুমু খাওয়া শেষ। নূর সম্ভতি ফিরে পেতেই চিৎকার দিয়ে আশমিন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে নিচে নেমে গেলো।মনে মনে কয়েকবার আউড়ালো,
— নির্লিজ্জ নির্লজ্জ নির্লজ্জ।
নূর যেতেই আশমিন আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পরলো। আপাতত তার কাজ শেষ। এখন নূর যা শুনেছে তা নিয়ে না ভেবে আশমিন কে গালি দিতে ব্যস্ত থাকবে।সব কিছু তারাতাড়ি করতে হবে। নাহ,আর কয়েকটা চুমু খেতে পারলে ভালো হতো। মেয়ে বিয়ে করেছে না চিংড়ি মাছ দ্বিধায় আছে আশমিন। সারাক্ষণ তিড়িংতিড়িং করতে থাকে।কালকেই বাজার থেকে ভালো দেখে একটা দড়ি কিনে আনাবে সে।আদরের সময় নো তিড়িংতিড়িং। ভোতা মুখ নিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো সে।এখন একটা ঘুম দরকার।
কামিনী চৌধুরী ফ্যাচফ্যাচ করে কেদেই যাচ্ছে। আমজাদ চৌধুরীর সেদিকে হুস নেই। ছাদ থেকে নেমে অস্থির ভাবে পায়চারি করে যাচ্ছে সে।কামিনী কি এমন করছে ভাবতে ভাবতে চুল ছেড়ার জোগাড়। কামিনী চৌধুরীর নাক টানার শব্দে বিরক্তিতে মুখ কুচকে ফেললো আমজাদ চৌধুরী।রুক্ষ গলায় বলল,
— কি সমস্যা তোমার কামিনী? এভাবে ফ্যাচফ্যাচ করে কেদে আমার মাথা ব্যথা আর বাড়িয়ে দিয় না।বিরক্ত লাগছে।দয়া করে কান্না বন্ধ করে বলো কি এমন করেছো যার জন্য ছেলে এমন ধ্বংসের খেলায় নেমেছে।নিজের পেটের ছেলেকে তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ চেনে না কামিনী। সে যা বলে তাই করে।বুড়ো বয়সে সতিনের সংসার না করতে চাইলে সত্যি টা আমাকে বলো।
কান্না বন্ধ করে ভয়ার্ত চোখে তাকালো কামিনী চৌধুরী। এতো বছরের পাপ কি তবে ছেলের সামনে চলে এসেছে!কাপা কাপা গলায় বলল,
— আ আমি ক কিছু করি নি আমজাদ। তোমার ছেলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। চলো আমরা কানাডা ফিরে যাই।ওখানে আমাদের যা আছে তা দিয়ে আমাদের চলে যাবে।
আমজাদ চৌধুরী শান্ত চোখে তাকালো কামিনী চৌধুরীর দিকে। হীম গলায় বলল,
— আমাদের কিছু নেই কামিনী। আমি আজ সকালে সব কিছু আশমিনের নামে করে দিয়েছি।
নূর নিজের ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিলো। হুট করে আশমিন কে দেখে ভ্রু কুচকে ফেললো। আশমিন নূরের কাছে গিয়ে মুখোমুখি দাড়ালো। নূর ল্যাপটপ ছেড়ে আশমিনের সামনে দাড়াতেই আশমিন মলিন হাসলো। ক্লান্ত গলায় বলল,
আরো পড়ুন : ইট পাটকেল পর্ব ১
ইট পাটকেল পর্ব ২
ইট পাটকেল পর্ব ৩
ইট পাটকেল পর্ব ৪
ইট পাটকেল পর্ব ৫
ইট পাটকেল পর্ব ৬
ইট পাটকেল পর্ব ৭
ইট পাটকেল পর্ব ৮
ইট পাটকেল পর্ব ৯
ইট পাটকেল পর্ব ১০
ইট পাটকেল পর্ব ১১
ইট পাটকেল পর্ব ১২
ইট পাটকেল পর্ব ১৩
ইট পাটকেল পর্ব ১৪
ইট পাটকেল পর্ব ১৫
ইট পাটকেল পর্ব ১৬
ইট পাটকেল পর্ব ১৭
ইট পাটকেল পর্ব ১৮
ইট পাটকেল পর্ব ১৯
ইট পাটকেল পর্ব ২০
ইট পাটকেল পর্ব ২১
ইট পাটকেল পর্ব ২২
ইট পাটকেল পর্ব ২৩
ইট পাটকেল শেষপর্ব ২৪
— আমাকে একটু জরিয়ে ধরবে নূর?
আশমিনের এমন গলা শুনে হালকা কেপে উঠলো নূর। জহুরি চোখে পর্যবেক্ষণ করল আশমিন কে।রাগী গম্ভীর লোকটা কে আজ ভঙ্গুর লাগছে।নূর এগিয়ে গিয়ে আশমিন কে হালকা হাতে জরিয়ে ধরলো। আশমিন তাদের মধ্যকার ফাকা টুকু ঘুচিয়ে নূর কে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। নূরের দম বন্ধ হয়ে আসছে। তবুও কিছু না বলে আশমিন কে শান্ত হতে সময় দিলো।আশমিনের বুকের কাপনি স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে।কপালে কয়েকটা ভাজ পরলেও খুব একটা পাত্তা দিল না।কয়েক মিনিট এভাবে কাটার পর নূর নিজের মুখ খুললো।
— খারাপ সময়ে এভাবে জরিয়ে ধরার জন্য একজন মানুষ দরকার।যে হবে একান্ত ব্যক্তিগত। সে দিক থেকে আপনি আমার চেয়ে লাকি মন্ত্রী সাহেব। আমি আবার খারাপ সময়ে মানুষ কে দুরছাই করতে পারি না।
নূর কে ছেড়ে দূরত্ব বজায় রেখে দাড়ালো আশমিন।নূরের সুক্ষ্ম খোচা সে বুঝতে পেরেছে। নির্লিপ্ত চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো। নূর গভীর মনযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো পুরোটা। আশমিন বরাবরের মতো শান্ত গলায় বললো,
— তুমি আমার থেকেও ভাগ্যবান নূর। আমি আগেও বলেছি এখন ও বলছি,কখনো এমন কোন কাজ করবে না যার জন্য পরে অপরাধবোধে ভোগো।ধনুক থেকে বেরিয়ে যাওয়া তীর আর মানুষের মুখের কথা কখনো ফেরত আসে না। তোমাকে বলা আমার কথাগুলো ও কিন্তু আমি ফিরিয়ে নিতে পারিনি। আমার তখনকার অপারগতা ও ওই কথাগুলো কে মলিন করতে পারে নি। একই ভুল তুমি করলে আমার খারাপ লাগবে।
কথা গুলো বলে যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই চলে গেলো আশমিন। নূর শান্ত চোখে তাকিয়ে দেখলো আশমিনের চলে যাওয়া।কিছুতো একটা হয়েছে। কিন্তু কি হয়েছে তা বুঝতে পারছে না নূর।
সেদিন রাতে এভাবে নূরের লাগানো আ*গুন নিভিয়ে দিয়ে নূরকে অনেকটা কাছে টেনে নিয়েছিল আশমিন।দীর্ঘ ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে এত কাছাকাছি আসা হয়নি তাদের।আশমিন অনেকটা ডুবে গিয়েছিল নূরের মাঝে ভেজা দুটো শরীর একসাথে লেপ্টে ছিল অনেকটা সময়। আশমিন অবাধ বিচরণ করেছে নূরের উপর। দুজনের নিশ্বাস পাল্লা দিয়ে ভারী হচ্ছিল। আশমিন নূরের বুক থেকে মুখ তুলে আশমিনের ওষ্ঠদ্বয় দখল করে নিতেই নূর আশমিন কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। হুট করেই আশমিন কে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। নূর চোখ বন্ধ করে হাপাচ্ছে।উপর থেকে পানি পরা বন্ধ হয়নি এখনো। নূরের শরীরে পরা পানির বিন্দু গুলো এক একটা মুক্তোর দানা মনে হচ্ছে আশমিনের কাছে।গায়ে লেপ্টে থাকা সাদা শার্ট টা খুলে ফ্লোরে ছুড়ে দিয়ে নূর কে কোলে তুলে নিলো আশমিন। ততক্ষনে ঘোর থেকে বেরিয়ে এসেছে নূর।আশমিনের কোল থেকে নামার জন্য মোচড়া মুচড়ি করতেই আশমিন বাকা হাসলো। নূরের রক্তিম নাকে হালকা কামড় দিয়ে ভরাট গলায় বলল,
— মোচড়া মুচড়ি করে লাভ নেই। বাসর করতেই তো এসেছো।এখন তোমাকে কিছু না করেই ছেড়ে দিলে তুমি আমার সম্পর্কে ভুলভাল ভাবতে পারো।তবে আমি এভাবে বাসার করতে চাই না বুঝলে।তাই আজ শুধু হতে হতে ও হইলো না টাইপ বাসর হবে। আগুনের ভেজা বাসর।
নূর হতভম্ব হয়ে কথা বলতেই ভুলে গেলো। হাজার কিল ঘুসি দিয়েও আশমিনের হাত থেকে মুক্তি পেলো না। নিজের নখ রাক্ষুসিদের মতো না রাখার জন্য নিজেকেই ভৎসনা করতে লাগলো। তাহলে অন্তত খামচে খামচে এই অসভ্য লোকের চেহারার নকশা বদলে ফেলা যেতো। সেদিন এক অন্য আশমিন কে আবিষ্কার করেছিল নূর।যাকে ভাবলে মনের মধ্যে শুধু একটা কথাই আসে।আর তা হলো, অসভ্য অসভ্য অসভ্য।
পরের দিন থেকেই দুজন ঠান্ডা জ্বর লাগিয়ে কেলেঙ্কারির বাধিয়ে ফেললো। আশমিন কে দেখে সানভির মনে হলো তার সামনে একটা পাকা টমেটো ঝুলে আছে।বাসর করতে গিয়ে এভাবে জ্বর বাধানোর কি হলো আজব!এমন হলে তো সে মোটেও বাসর টাসর করবে না। আশমিন জ্বর নিয়ে পরপর কয়েক টা মিটিং করে ফেললো। এদিকে নূর শুধু বিছানায় শুয়ে শুয়ে আশমিন কে বকে গেলো। কয়েক হাজার অভিশাপ দিয়ে ও খান্ত হলো না। আশমিনের কাবার্ডের সমস্ত সাদা শার্ট গুলো জ্বালিয়ে দিলো।এই সাদা শার্ট পরা দেখেই সে পিছলে গিয়েছিল। দুই দিন রুমের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে রইলো। এই অবস্থায় বাইরে গিয়ে লোক হাসানোর মানেই হয় না। অথচ আশমিন নির্দিধায় নিজের কাজ করে গেলো।একবেলায় জ্বর ছেড়ে গেলেও ঠান্ডা তাকে কুপকাত করে ফেললো। আশমিন কয়েক বার বিরবির করে বলে ও ফেললো, বউয়ের অভিশাপ বউয়ের অভিশাপ।
তার পর থেকে টানা সতের দিন দুজনের দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ। নূর আশমিন কে এড়িয়ে চলেছে এ কয়দিন।আশমিন ও সেদিকে পাত্তা দেয় নি। আজ হুট করেই আশমিন এভাবে সামনে চলে এসে বিভ্রান্ত করে দিয়ে গেলো নূর কে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো নূর। আকাশের মস্তো বড় চাদের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো নিজের অগোছালো জীবন নিয়ে।সব কিছু স্বাভাবিক থাকতে পারতো।অন্য সব মেয়েদের মতো সে ও একটা সাজানো গোছানো সংসার করতে পারতো।কয়েকজন মানুষের লোভ তাদের জীবন টা এলো মেলো করে দিয়েছে।ফোনের শব্দে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো নূর।
— বলো অমি।
— ম্যাম, মতি মিয়ার খোজ পাওয়া গেছে।আজ সকালে আশমিন স্যারের লোকেরা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।কিছুক্ষণ আগে থেকেই তার আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার পরিবার ও কয়েক ঘন্টার মধ্যে উধাও।
— তাদের খোজা বন্ধ করো অমি।আপাতত তোমার স্যারের উপর নজর রাখো।সে যেন বুঝতে না পারে কিছু।
— ওকে ম্যাম।
অমি ফোন রাখতেই নূর চাঁদ দেখায় মনোযোগ দিল।
— এই খেলার শেষ ধাপে আপনি ই আমাকে নিয়ে যাবেন মন্ত্রী সাহেব। আজ থেকে আমার কাজ গুলো আপনার। (বাকা হেসে)
সকালের নাস্তার টেবিলে আশমিন কে সবার আগে উপস্থিত হতে দেখা গেলো। নিজের মতো করে গুন গুন করছে সে।নূর রেডি হয়ে এসে বসলো তার চেয়ারে।আশমিনের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। আমজাদ চৌধুরীর ছেলের মতিগতি ভালো ঠেকছে না। কামিনী চৌধুরীর সেদিকে ধ্যান নেই। সে নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছে। একজন গার্ড এসে একটা খাম কামিনী চৌধুরীর দিকে এগিয়ে দিলো। রেজিস্ট্রার করা এনভেলাপ। কামিনী চৌধুরী ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকালো।
— এখানে আপনার সাইন লাগবে ম্যাম।
গার্ডের কথায় রেজিস্ট্রার খাতায় সাইন করে খামটি হাতে নিল সে।ভিতর থেকে বের হওয়া ডকুমেন্ট পড়তেই মাথা ঘুরে গেল তার।হাত পা কাপতে লাগলো। নূর বাকা হেসে নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছে। আমজাদ চৌধুরী সন্দিহান গলায় বলল,
— এটা কিসের কাগজ কামিনী?
কামিনী চৌধুরী কিছু বলতে পারলো না। অতিরিক্ত শকে কথা বের হচ্ছে না মুখ থেকে। নূর সেদিকে তাকিয়ে বাকা হেসে বললো,
— কোর্ট থেকে নোটিশ এসেছে।কোম্পানি থেকে সারে তিন শ কোটি টাকা হেরফের করার জন্য তাকে কোম্পানি কে চার শ কোটি টাকা ফেরত দিতে হবে। তা ও আগামি দুই মাসের মধ্যে।
আমজাদ চৌধুরী হতভম্ব হয়ে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালো। আশমিন একটা পেপার আমজাদ চৌধুরীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
— এসব বাদ দাও আব্বু।এখানে একটা সাইন লাগবে। তারাতাড়ি করে দাও তো।
আমজাদ চৌধুরী হতভম্ব চোখে পেপারের দিকে এক পলক তাকালো। কয়েক পলক সেদিকে তাকিয়ে থেকে নির্লিপ্ত ভাবে সাইন করে দিলো পেপারে।
ছাদের রেলিংয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে আশমিন।সব সময় গোছানো ছেলেটা আজ প্রচন্ড অগোছালো হয়ে নিজের জীবনের হিসেব মিলাতে ব্যস্ত। অনুভূতিহীন চোখ গুলো আজ পরাজিত সৈনিকের মতো নত হয়ে আছে।আমজাদ চৌধুরী এসে সন্তপর্ণে ছেলের পাসে বসলো।আশমিন বাবার দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমজাদ চৌধুরী তপ্ত শ্বাস ছেড়ে আশমিনের কাধে হাত রাখলো।দুজনের সম্পর্ক সাপে নেউলে হলেও এক জন আরেকজনের জন্য জান দিতেও প্রস্তুত। দুজনের সম্পর্ক অনেকটা বাচ্চা কালের বন্ধুদের মতো। সারাক্ষণ একজন আআরেকজনের পিছনে লেগে থাকতে মজা পায় তারা।কিন্তু একজনের মনের আকাশে মেঘ জমলে আরেক জন অস্থির হয়ে উঠে।
— কিছু বলবে আব্বু?
— কি হয়েছে বাবা।সকাল থেকেই লক্ষ্য করছি।এমন উদ্ভট বিহেইভ করছো কেন?
আশমিন শান্ত চোখে তাকালো তার বাবার দিকে।বাবার সহজ সরল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বুক টা হু হু করে উঠল।এমন একজন মানুষ কে কেউ কিভাবে ঠকাতে পারে! সেই মানুষ টা যদি হয় নিজের গর্ভধারিণী মা এটা জানার পর এই মানুষ টা পারবে তো নিজেকে সামলাতে?
— আমাকে খুলে বলো বাবা।
আমজাদ চৌধুরীর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো আশমিন। বাবার চোখের দিকে তাকালে কষ্ট হয় খুব।বাবা কে ভালোবাসে।প্রচন্ড ভালোবাসে। সেই বাবা কে এভাবে কেন ঠকাল কামিনী চৌধুরী! চোখ বন্ধ করে ফেললো আশমিন। রাগ হচ্ছে তার। সব কিছু ধ্বংস করে দেয়ার মতো রাগ।
— ছবি গুলো দেখেছো আব্বু?
আমজাদ চৌধুরী হতাশ হলেন।ছেলের মুখ দেখে কখনোই তার মনের খবর বোঝা যায় না।তাই সে সরাসরি জানতে চেয়েছিল।কিন্তু ছেলে তার মুখ খুলছে না।
— এসব কি ধরনের কথা আশমিন? আমি কেন আবার বিয়ে করতে যাবো? তুমি জানো তোমার এই আচরণের জন্য তোমার আম্মু কতটা কষ্ট পেয়েছে? তোমার কাছে এমন কথা আশা করি নি।
আমজাদ চৌধুরীর গলায় তীব্র হতাশা আর ক্ষোভ। আশমিন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আমজাদ চৌধুরীর দিকে। ছেলের দৃষ্টি দেখে থমকে গেলো আমজাদ চৌধুরী।দুই হাতে ঝাপটে ধরে কেদে উঠলেন।
— কি হয়েছে বাবা? আমাকে বলো?তুমি এখনো আমার কাছে সেই ছোট্ট আশু।যাকে আমি কাধে নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছি। দুই হাতে যাকে আমি প্রথম কোলে তুলে নিয়েছি।হাটা শিখিয়েছি, কথা বলা শিখিয়েছি।তুমি আমার কাছে এখনো সেই আধো আধো বুলিতে আব্বু ডাকা আশমিন ই আছো।আগে যেভাবে আব্বুর কাছে নিজের সমস্ত অভিযোগ অভিমান খুলে বলতে তেমন এখনো বলো বাবা।
আশমিন তার বাবাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো। ছেলের চোখের পানি দেখে দিশেহারা হয়ে গেলো আমজাদ চৌধুরী।আজ পর্যন্ত ছেলে কে সে কাদতে দেখে নি। এমন কি নূর চলে যাওয়ার পরে যখন মাইনর এট্যাকের জন্য হসপিটালাইজ হলো তখন ও আশমিন কাদে নি।রক্তিম চোখে শুধু তাকিয়ে থাকতো।
আজ কি এমন হয়েছে যার জন্য তার ছেলের চোখের পানি কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে?
কয়েক মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিলো আশমিন। চোখের পানি মুছে আমজাদ চৌধুরীর ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকালো।তার কান্না ভেজা চোখ দেখে সেও কেদে দিয়েছে। ভিতর থেকে কান্না গুলো আবার দলা পাকিয়ে এলো। আশমিন আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,
— আমার কথা মেনে নাও বাবা।
— পাগল হয়ে গেছো?নিজের মায়ের সংসার ভাঙ্গতে চাইছো!আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি তোমার কথা শুনে। (হতভম্ব গলায়)
— আমি চাই সে কষ্ট পাক আব্বু।আপনজন হারালে কেমন লাগে তার বোঝা উচিত। কাছের মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা করলে কতটা কষ্ট হয় তা হাড়ে হাড়ে বুঝবে এবার।তার লোভ তাকে কোথায় নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে আমি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাই আব্বু। আর তাকে তার সম্রাজ্য থেকে টেনে নামাবো আমি।
আমজাদ চৌধুরী এবার ঘামতে লাগলো। কি করেছে কামিনী? এই প্রশ্ন টা করতে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সে এমন কিছু শুনতে চায় না যা শুনলে সে ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবে।
— তুমি সহ্য করতে পারবে না আব্বু।তার মৃ*ত্যু অবধারিত। তার লোভ তাকে খু*ন করবে। আগামী সপ্তাহে তোমার বিয়ে। এখন গিয়ে ঘুমাও।মেয়ে আমি নিজেই পছন্দ করে নিবো।
— আমি ওকে ভালোবাসি আশমিন।
আমজাদ চৌধুরীর গলা টা হালকা কেপে উঠলো।
— সে তোমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়।
আশমিনের গলা নির্লিপ্ত। আমজাদ চৌধুরী টলমল পায়ে চলে গেলেন ছাদ থেকে।
নূর তীক্ষ্ণ চোখে সবকিছু দেখলো।এতক্ষণ সে ছাদের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল।পরিস্কার ভাবে কিছু না বুঝলে ও এটা ঠিক বুঝলো যে আশমিনের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।সকালে সব কিছু মজা ভেবে উড়িয়ে দিলেও এখন বিষয় টা খুব ভাবাচ্ছে তাকে।হঠাৎ হেচকা টানে তাল সামলাতে না পেরে কারোর শক্ত বুকের সাথে তার মাথার সংঘর্ষ হয়ে গেলো। ব্যথা পেলেও কিছু বললো না সে। এটা আশমিন ছাড়া কেউ না সে জানে।
— প্রেম পাচ্ছে?
বিরক্ত চোখে তাকালো নূর।প্রেম কেন পাবে আজব? এখানে প্রেম পাওয়ার মতো কি হয়েছে এখানে?একদিন নিজের মন মীরজাফরি করেছে বলে কি প্রতিদিন ই সে পিছলে যাবে নাকি।
— ছারুন।সব সময় এভাবে গা ঘেষাঘেসি করেন কেন?
আশমিন অবাক হওয়ার ভান করে আর্তনাদ করে বললো,
— মিথ্যা কথা! আমি সারাক্ষণ তোমার গা ঘেসাঘেসি করি না নূর। আমার কতো কাজ জানো তুমি? আমি শুধু মাঝে মধ্যে হালকা ঘেষাঘেসি করি।তাতেই তুমি দু দিন রুম থেকে বের হতে পারো না(শয়তানি হেসে)।
নূর হা করে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে চিৎকার করে বললো, চুপ করুন। আপনি একটা অশ্লিল গিরগিটি।
আশমিন নূরের মুখভঙ্গি কে পাত্তা না দিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
— আমার কি মনে হয় জানো?আমরা যখন জেনারেশন বাড়ানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করতে ট্রায় করবো তখন আর তোমাকে খুজেই পাওয়া যাবে না। দেখা গেলো তুমি কোন সাইন্স ল্যাবে অসহায় হয়ে ঝুলছো।তাই তোমার এতো বড় একটা টাস্কে ইনভলভ হওয়ার আগে উচিত নিয়মিত একটু একটু করে প্র্যাকটিস করা। আসো আমরা বরং সময় টাকে কাজে লাগাই।আমি থাকতে তোমার কোন চিন্তা নেই।মিনিষ্টার আশমিন জায়িনের বউ হয়ে তুমি কোন ল্যাবে কংকাল হয়ে ঝুলবে এটা মেনে নেয়া যায় না। ব্যপার টা লজ্জাজনক।
নূর হতভম্ব হতেও ভুলে গেলো। আশমিনের কথা গুলো মাথায় তাল গোল পাকিয়ে খিচুড়ি হয়ে গেলো। সে শুধু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। এদিকে আশমিনের কয়েকদফা চুমু খাওয়া শেষ। নূর সম্ভতি ফিরে পেতেই চিৎকার দিয়ে আশমিন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে নিচে নেমে গেলো।মনে মনে কয়েকবার আউড়ালো,
— নির্লিজ্জ নির্লজ্জ নির্লজ্জ।
নূর যেতেই আশমিন আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পরলো। আপাতত তার কাজ শেষ। এখন নূর যা শুনেছে তা নিয়ে না ভেবে আশমিন কে গালি দিতে ব্যস্ত থাকবে।সব কিছু তারাতাড়ি করতে হবে। নাহ,আর কয়েকটা চুমু খেতে পারলে ভালো হতো। মেয়ে বিয়ে করেছে না চিংড়ি মাছ দ্বিধায় আছে আশমিন। সারাক্ষণ তিড়িংতিড়িং করতে থাকে।কালকেই বাজার থেকে ভালো দেখে একটা দড়ি কিনে আনাবে সে।আদরের সময় নো তিড়িংতিড়িং। ভোতা মুখ নিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো সে।এখন একটা ঘুম দরকার।
কামিনী চৌধুরী ফ্যাচফ্যাচ করে কেদেই যাচ্ছে। আমজাদ চৌধুরীর সেদিকে হুস নেই। ছাদ থেকে নেমে অস্থির ভাবে পায়চারি করে যাচ্ছে সে।কামিনী কি এমন করছে ভাবতে ভাবতে চুল ছেড়ার জোগাড়। কামিনী চৌধুরীর নাক টানার শব্দে বিরক্তিতে মুখ কুচকে ফেললো আমজাদ চৌধুরী।রুক্ষ গলায় বলল,
— কি সমস্যা তোমার কামিনী? এভাবে ফ্যাচফ্যাচ করে কেদে আমার মাথা ব্যথা আর বাড়িয়ে দিয় না।বিরক্ত লাগছে।দয়া করে কান্না বন্ধ করে বলো কি এমন করেছো যার জন্য ছেলে এমন ধ্বংসের খেলায় নেমেছে।নিজের পেটের ছেলেকে তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ চেনে না কামিনী। সে যা বলে তাই করে।বুড়ো বয়সে সতিনের সংসার না করতে চাইলে সত্যি টা আমাকে বলো।
কান্না বন্ধ করে ভয়ার্ত চোখে তাকালো কামিনী চৌধুরী। এতো বছরের পাপ কি তবে ছেলের সামনে চলে এসেছে!কাপা কাপা গলায় বলল,
— আ আমি ক কিছু করি নি আমজাদ। তোমার ছেলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। চলো আমরা কানাডা ফিরে যাই।ওখানে আমাদের যা আছে তা দিয়ে আমাদের চলে যাবে।
আমজাদ চৌধুরী শান্ত চোখে তাকালো কামিনী চৌধুরীর দিকে। হীম গলায় বলল,
— আমাদের কিছু নেই কামিনী। আমি আজ সকালে সব কিছু আশমিনের নামে করে দিয়েছি।
আমার জীবন বিডিতে নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন, প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url